জয়পুরহাটে ধান বিক্রিতে প্রকৃত মূল্য না পাওয়ায় দিশেহারা কৃষকেরা
জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ
আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান বিক্রি নিয়ে বড় বিপদে পড়েছে জয়পুরহাটের চাষীরা। ফলন বাম্পার হলে কি হবে, বাজারে দাম ও চাহিদা না থাকায় তাদের মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ধানের দাম কমে যাওয়ায় হতাশায় ভূগছেন চাষীরা। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিদিন ধীর গতিতে কম দামে ধান কিনছেন বলে অভিযোগ চাষীদের। সেই সাথে অন্য এলাকা থেকে ধান ক্রয় করতে আসা ব্যবসায়ীদের বাজারগুলোতে নামতে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে ধান বিক্রি করে চাষীরা মোটা অংকের লোকসান গুণলেও কৌশলে এলাকার মিল-চাতাল মালিক, ফরিয়া ও মহাজনরা কম দামে ধান কিনে অল্প দিনেই বেশী লাভ করছেন।
তবে জোটবদ্ধ হয়ে ধান ক্রয় এবং অন্য জেলার ব্যবসায়ীদের নামতে না দেওয়ার বিষয় অস্বীকার করে উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজ বলেন ভিন্ন কথা। এলাকার প্রত্যেক ব্যবসায়ীর গুদামে গত আমন ও বোরো মৌসুমের ধান-চাল এখনও পর্যাপ্ত পরিমান মজুত রয়ে গেছে। তা ছাড়া মিলাররা এখনও ব্যাপক হারে ধান কিনতে শুরুই করেননি। সবকিছু মিলে বর্তমানে ধানের বাজার নিম্নমুখী চলছে। মিলররা পুরোদমে ক্রয় শুরু করলেই ধানের দাম আবারও বাড়বে।
উপজেলার বৃহৎ ধানের হাট কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজার ও পুনট হাটে গিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন পাঁচশিরা বাজারে সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত জয়পুরহাট-বগুড়া মহাসড়কের দুইপাশে পাঁচশিরা বাজারে ধান বেচাকেনা হয়। আবার বৃহস্পতিবার ও সোমবার পুনটে ধানের হাট বসে। জেলার কৃষকরা ছাড়াও এই দুই হাটে পাশ্ববর্তী বগুড়া জেলার কৃষকরাও ধান বিক্রি করতে আসেন। সকাল থেকেই মহাসড়কের দুই পাশে ধান বোঝাই সারি সারি ভ্যান ও ভটভটি দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে আমদানির তুলনায় বেচাকেনা চলছিল ধীর গতিতে। হাটে ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও ছিল কম। তাইতো বেলা গড়ার সাথে সাথে অনেককেই ধান বিক্রি করতে না পেরে ফেরত নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
তবে এই হাটে বগুড়ার সোনাতলা থেকে ধান ক্রয় করতে আসা মিনারুল ইসলাম জানান, তিনি এই হাটে এসে ধান ক্রয় করতে পারেননি। তাকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ধান ক্রয় করতে দেননি। বাধ্য হয়ে ধান ক্রয় না করেই তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। তার মত আরও অনেককেই ফিরে যেতে হয়েছে।
সকালে পাঁচশিরা বাজারে ধান বিক্রি করতে এসে উপজেলার শিকটা গ্রামের আব্দুল কাফির সাথে কথা হয়। এ সময় তিনি বলেন, দুইটি ভটভটিতে ৪০ মণ চিকন কাটারি জাতের ধান বাজারে এনে বড় বিপদে পরেছি। ধান কেনার জন্য তেমন লোকজনই আজ হাটে আসেনি। শুনতে পেলাম স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বাহিরের ব্যবসায়ীদের এই হাটে নামতে দেয়নি। তারা নিজেরাই জোটবদ্ধ হয়ে কম দামে ধান কিনবে। বাধ্য হয়ে ধান বাড়িতে ঘুরে নিয়ে যাচ্ছি। কিভাবে ধান কাটার শ্রমিকদের বিদায় করবো তা ভেবে পাচ্ছিনা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাটের ৫টি উপজেলায় এবার ৬৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। আলুর পরে বোরোর আবাদ শুরু করায় মাঠে ধান পাকতেও দেরি হচ্ছে। তবে ধান কাটা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত পুরো জেলার ধান কর্তন হয়েছে ৩৫ শতাংশেরও কম। এবার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন।
আঁওড়া গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, গত সপ্তাহে প্রতি মণ কাটারি জাতের ধান (৪০ কেজি) ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা, জিরাশাইল ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকা, মোটা জাতের আতপ ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ গত আজ বৃহস্পতিবার বাজারে সেই কাটারি জাতের ধান প্রতি মণ ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকায়, জিরাশাইল ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকা, মোটা আতপ ৯০০ থেকে ৯৫০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে গড়ে প্রতি মণে কমে গেছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, এবার প্রতি বিঘায় উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৪ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাজারে সব কিছুর দাম বেশি। আবার ধানের দামও কম। কিভাবে কৃষক বাঁচবে সে চিন্তা কারই নেই। সব ঝামেলা কৃষকের।
হাতিয়র গ্রামের কৃষক আব্দুল আলিম বলেন, শুরুতে ধান বিক্রি না করে বড় ভূল করেছি। আজ তার খেশারত গুনতে হচ্ছে। ধান ধরে রাখলাম লাভের আশায়, এখন লাভ তো দূরের কথা উল্টো মূল ধন খুঁইয়ে লোকশান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ধানের বিকল্প ফসল ফলানোর চিন্তা না করে কোনো উপায় নেই।
জয়পুরহাট কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায় বলেন, বাজারে ধানের আমদানি বেড়ে গেছে। সে কারণে ধানের দাম কমতে পারে। আবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেও ধানের দাম কমতে পারে। আমরা বিষয়টি মাথায় নিয়েছি। আমাদের বাজার মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে।