কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক
মোঃজোনায়েদ হোসেন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি:
কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে(!) তালাকের শিকার হয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের এক হতভাগ্য মা আফরোজা আক্তার বিয়ের মাত্র পৌনে দুই বছরের মাথাতেই ভাঙলো সংসার । সালিশ, দেন- দরবার, হাতে- পায়ে ধরা কোনো কিছুতেই টেকাতে পারেননি সংসার । স্বামী রুহুল আমিন বলছেন মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি একথা ঠিক না ।
জানা গেছে, আফরোজা আক্তার( ২২) কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কামারহাটিয়া গ্রামের আবুল হাশেমের মেয়ে । ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি পারিবারিকভাবে পার্শ্ববর্তী নোয়াবাদ ইউনিয়নের সিন্দ্রিপ গ্রামের সাবেক মেম্বার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে রুহুল আমিনের সঙ্গে বিয়ে হয় আফরোজার । রুহুল আমিন( ৩০) একজন আনসার সদস্য । বর্তমানে তিনি জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় কর্মরত । তার স্বপ্ন ছিল প্রথম সন্তান হবে ছেলে । কিন্তু স্ত্রীর কোলজুড়ে এসেছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান ।
এ ‘ অপরাধে ’ স্ত্রী আফরোজা আক্তারের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন । অবশেষে তাকে তালাক দেন স্বামী রুহুল আমিন । স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ছোট শিশুটিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন এখন অসহায় ওই নারী । বিষয়টি নিয়ে কয়েক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে সালিশ বৈঠক হলেও মন গলেনি স্বামী রুহুল আমিনের । তিনি কন্যা সন্তানের মুখ থেকে ‘ বাবা ’ ডাক শুনতে চান না বলে সালিশে সাফ জানিয়ে দেন । সালিশে তাকে চরমভাবে ধিক্কার জানানো হলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন । এ ঘটনায় সালিশকারীরা হতভম্ব হয়ে যান । এলাকার লোকজন হন বিস্মিত । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে এখন চলছে তোলপাড় ।
২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রুহুল- আফরোজার বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল এবং প্রায় ২ লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয় । বিয়ের পর ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার । কিছুদিন পরই গর্ভধারণ করেন আফরোজা ।
আফরোজা অভিযোগ করে বলেন, ‘ বাচ্চা যখন পেটে আসে তখন অসুস্থ হয়ে যাই । ৮ মাসের সময় আমি বাবার বাড়িতে চলে আসি । স্বামী আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলে । আলট্রাসনোগ্রাম করাতে গিয়ে জানা গেল, আমার মেয়ে বাচ্চা হবে । এ খবর শুনেই বদলে যায় রুহুল । সে এরপর থেকে আমার সঙ্গে মোবাইলে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে । আমাকে এক নজর দেখতেও আসেনি । জানিয়ে দেয়, মেয়ে হলে তার মুখও দেখতে আসবে না । এ পরিস্থিতিতে গত ২৫শে জানুয়ারি জন্ম নেয় আমার মেয়ে সন্তান । নাম রাখি ‘ নুসরাত ’ । যার অর্থ ‘ সমর্থন ’ বা ‘ প্রতিরক্ষা ’ । ’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফরোজা বলেন, ‘ আমি ভেবেছিলাম, নুসরাতের মুখ দেখে ওর বাবার মন পাল্টে যাবে । কিন্তু তা আর হয়নি । নুসরাত হওয়ার একমাস পর, স্বামী রুহুল মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে আর ঘর করবে না বলে মৌখিকভাবে তালাক দিয়ে দেয় । নুসরাত আমাকে ‘ প্রতিরক্ষা ’ দিতে পারেনি । ’
আফরোজার বড় ভাই আব্দুল হালিম বলেন, বিয়েতে রুহুলকে একটি মোটরসাইকেল ও প্রায় ২ লাখ টাকার ফার্নিচার দেয়া হয় । মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়ায় রুহুলের মন খারাপ হলে আমরা প্রস্তাব দেই, শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনে আরো ২ লাখ টাকা দেবো । তারপরও আমার বোনের সংসার টিকাতে পারিনি ।
আফরোজার মেয়ে নুসরাতের বয়স এখন ৮ মাস । শিশুটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিষয়টি মীমাংসার উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী । গত ২৮শে আগস্ট জয়কা ইউনিয়ন পরিষদে এ ব্যাপারে সালিশের আয়োজন করা হয় । এতে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন, পাশের ইউনিয়ন গুনধরের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির নূরু শিকদারসহ অন্তত ৩ ইউনিয়নের গণ্যমান্য লোকজন উপস্থিত ছিলেন । ওই সালিশেও কোনো কাজ হয়নি । সালিশ শেষে লিখিতভাবে তালাক পান আফরোজা ।
সালিশে উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এমদাদুল হক বলেন, ‘ রুহুল আমিন কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে ক্ষিপ্ত হন । তিনি ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন । আর এ কারণে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেন বলে সালিশে প্রমাণ হয় । ’ তিনি আরও বলেন, সালিশে উপস্থিত প্রায় সবাই রুহুলকে বুঝিয়ে ব্যর্থ হয় । পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে লিখিত তালাকের ব্যবস্থা করা হয় ।
জয়কা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি মীর হুসেন বলেন ” শালিশে রুহুল স্পষ্ট ভাষায় বলেন মেয়ে সন্তান আমি চাই না, আমি তাকে নিয়ে কিছুতেই সংসার করতে ইচ্ছুক নই আমি । তার কথায় শালিশে উপস্থিত জনতা হতভম্ব হয়ে যায় । কিছুতেই তাকে বুঝানো যায়নি । আমরা সংসারটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, রুহুলের একগুয়েমির জন্য সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় ।
এ বিষয়ে জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সালিশে আফরোজার অন্য কোনো দোষত্রুটি দেখাতে পারেনি রহুল । কেবল মেয়ে বাচ্চা হওয়ার কারণে তালাকের ঘটনা ঘটেনি এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে ।
গুনধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাজমুল শাকির নূরু শিকদার বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি, যেহেতু তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে । সংসারটি যেন টিকে থাকে । কিন্তু রুহুলের একগুঁয়েমির কারণে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় ।
এ বিষয়ে রুহুল আমিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছি একথা ঠিক না । সে( আফরোজা) আমার কথা শুনতো না । মেয়ে হওয়ার পর সে আমার সঙ্গে আরো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করে । আমি কল দিলে প্রায় সময় তার নাম্বার বিজি থাকে । এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলে আমার মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করে । আরো নানাবিধ কারণে তাকে তালাক দিয়েছি আমি । ’ যদিও তার এসক খোঁড়া সালিশকারীদের বক্তব্যের সাথে একেবারেই মিলছেনা ।